ঘটনা: ১
ক্রিং... ক্রিং...
ক্রিং...
- হ্যালো! কে বলছেন?
- হ্যালো, দোস্ত!
বড়লোক মানুষ খোঁজ খবর নিস না। এখন দেখি ভুইলাই গেছস। বল তো আমি কে?
- রফিক? (অনুমান
করে)
- হ দোস্ত!
- তো কি খবর তোর?
- দোস্ত আর বলিস না
আম্মা খুবই অসুস্থ। মৃত্যু শয্যায়।
- আচ্ছা কি হইছে?
(সংযোগ বিচ্ছিন্ন)
বারবার চেষ্টার পরও
যখন কল যাচ্ছে না তখনই হঠাৎ ম্যাসেজ আসল 'আম্মা আর নাই'। তারপরই কল আসল।
- দোস্ত ম্যাসেজ তো দেখছই। আমি এতিম হয়ে গেলাম রে
(কান্নার শব্দ)
- না না কাঁদিস না। আচ্ছা আমি আসছি এখনই তোদের বাসায়।
- দোস্ত যখন আসবিই তখন ১০ হাজার টাকা নিয়ে আসিস।
আজ ঝামেলার কারণে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে পারিনি।
- আমার কাছে তো এই মুহূর্তে ৩ হাজার টাকা আছে।
- হবে দোস্ত তাই হবে। তুই একটা কাজ কর টাকাটা
বিকাশ কর। তোর এখানে আসতে তো সময় লাগবে । এই আমি নাম্বার ম্যাসেজ করলাম।
- আচ্ছা পাঠাচ্ছি।
নাহিদ ৩ হাজার টাকা
বিকাশ করল। করেই কল দিল তাকে কিন্তু মোবাইল বন্ধ। তারপর তাঁর আনুমানিক বন্ধু রফিক
(আসল) এর স্ত্রীকে কল করে বলল,
- ভাবি! রফিক তো ফোন ধরছে না। আমি তো বিকাশ করেছি।
তো আপনার শাশুড়ির জানাজা কখন?
- কি বলেন আবোল তাবোল? কিসের বিকাশ? শাশুড়ির জানাজা
আবার কোত্থেকে? তিনি তো পাক ঘরে পাক করে।
- তাহলে টাকা...?
নাহিদের মাথায় হাত।
ঘটনা: ২
আই এম এ শিলা...
শিলা কি...
- হ্যালো!
- স্যার আমি এয়ারটেল
থেকে আসিফ বলছি। আপনি আমাদের এখানে কুইজ কন্টেস্টে প্রথম হয়েছেন। আপনি পাচ্ছেন
৭৫,০০০ টাকা। আপনি এই টাকা নগদে নিতে পারেন অথবা ব্যাংক বা বিকাশের মাধ্যমে নিতে
পারেন। নগদে নিলে আপনাকে আমাদের বনানী তেজওয়াজ টাওয়ারে আসতে হবে। অন্যথায় আপনার
একাউন্ট নাম্বার আমাদের দিতে হবে আমরা পাঠিয়ে দিব।
- আচ্ছা তাই নাকি?
আমি আসলেই বিশ্বাস করতে পারছি না। আচ্ছা আমি আসছি।
- হ্যাঁ স্যার!
অবশ্যই আসুন তবে স্যার আমাদের কিছু ফর্মালিটি আছে তো। তার জন্য আপনি এখনই ৬০০ টাকা
রিচার্জ করুন। আমি আপনাকে একটা নাম্বার পাঠাচ্ছি। তবে হ্যাঁ অবশ্যই কে যেন না
জানে। কারন বুঝেনইতো। আর আগামিকাল আসার সময় কিছু টাকা সাথে নিয়ে এসেন। আরো কিছু ফর্মালিটি
আছে তো। ইউ আর সো লাকি ম্যান... (লাইন কেটে গেল)
নাম্বার পাঠানোর পর সদ্য বিলেত ফেরত তুহিন বনানীর দিকে রওয়ানা দিলেন। রাতে ঘরে ফিরলেন আধা দিগম্বর হয়ে। গালে কিল ঘুষির ছোপ ছোপ দাগ।
ঘটনা: ৩
টিং... টিং... টিং...
- হ্যালো!
- আমি জিনের বাদশা
বলছি। আমি জানি তুই অনেক অশান্তিতে আছিস। (ভরাট গলায়)
- জ্বি বাবা। আমার
স্বামীটা না...
- এই অশান্তি আরো
চলবে। তবে তুই যদি শাহজালালের দরগায় মান্নতে নিয়ত করিস তাহলে মুশকিল আসান। আর
আগামিকালই তোর আরেকটা ফাঁড়া আছে সেই ফাঁড়া কাটতে চাস?
- জ্বি বাবা। কিভাবে আমি তো এখন ঢাকায়।
- তাহলে তুই বিকাশ কর। তোর মোবাইলে যে ই
নাম্বারটা এসেছে সেই নাম্বারে। মনে রাখিস যদি কাউকে জানাস আর কথার ব্যতিক্রম হয়
তাহলে কিন্তু তোর ঘর না বংশেও আগুন জ্বলবে... আগুন
- জ্বি
বাবা!! জ্বি বাবা!!
এর
পরদিন যখন ঐ নাম্বারে ফোন করা হল তখন ওপাশ
থেকে আওয়াজ এল
- আপনার
ডায়ালকৃত নাম্বারটি এখন বন্ধ আছে।
এমন হাজারো ঘটনার নজির রয়েছে সমাজে। মানুষের সরলতার সুযোগে এই ধরনের প্রতারনা করে যাচ্ছে এই প্রতারক চক্র। কুইজ, লটারি, বিদেশি কোম্পানিতে চাকুরি ইত্যাদির অফার দিয়ে মানুষদের প্রতারনা করা হচ্ছে। বেশ শক্তিশালী এদের নেটওয়ার্ক। বেশ শিক্ষিত যুবকরাই এদের সাথে কাজ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রতারনার শিকার হয়ে কেউ কেউ সর্বস্বান্ত হয়েছেন। এই প্রতারক চক্রের প্রতারনার কিছু ফিরিস্তি নিম্নে তুলে ধরছি।
লটারি ও কুইজ কন্টেস্ট ফাদ:
হ্যালো! স্যার আপনি বাংলালিংক কুইজ কন্টস্টে উইন করেছেন (জিতেছেন)।
আপনি পেয়েছেন স্যামসাং গ্যালাক্সি - এইভাবে কথা শুরু করে এই চক্রের প্রতারকরা।
বিভিন্ন মোবাইলে বা বিভিন্ন জাতীয় পর্যায়ে চলা কুইজ এর খবর নিয়েই তারা এই ফন্দি
এঁটে থাকে। কখনো তারা মোবাইলে বিভিন্ন ডিজিট চাপতে বলে যেমন ০ ইত্যাদি। যদি কেউ সে
নাম্বারে চাপ দেয় তাহলে তাঁর ব্যাল্যান্স সাথে সাথেই শূন্য হয়ে যাবে। এটাকে বলা হয় 'সিম ক্লোনিং'। কখনো তারা নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য এম.ডি এর সাথে কথা
বলিয়ে দেয়। আবার কখনো তারা বলে এই এই ডিজিট চাপ দেন তারপর বলে যে আপনার আউটগোয়িং কল বন্ধ আপনি চেক করতে পারেন। কিন্তু এই সবই সাধারন মাত্রার সচেতন ব্যাক্তির কাছেই
ধরা পড়ে যায়। কেননা এই সকল কুইজ ও লটারির জন্য কখনই কোন এম.ডি কথা বলেন না। আর এই
ধরনের আউটগোয়িং কল বন্ধ যে কেউ করতে পারে নির্দিষ্ট কোম্পানির আউটগোয়িং কল বন্ধের
ডিজিট চেপে আর তারা সে ডিজিটটিই চাপতে বলে থাকে।
চাকুরি ও বিদেশে গমন ফাদ:
'আপনি এয়ারটেলে চাকুরির জন্য আবেদন করেছিলেন না? আপনার চাকুরি হয়ে
গেছে। আপনি নিশ্চয়ই এয়ারটেল ব্যবহার করেন । আর আমরা আমাদের চাকুরি প্রত্যাশিদের
মাঝে এক কন্টেস্টের আয়োজন করেছি যাতে আপনি সে সৌভাগ্যবান যে প্রথম হয়েছেন অথবা
আপনি প্রথম সিম ব্যবহারকারী হিসেবে পাচ্ছেন... লাখ টাকা অথবা আমাদের কোম্পানির
এম.ডি আপনাকে আমাদের বিদেশ ব্রাঞ্চে নিয়োগ দিতে আগ্রহী, কংগ্রাচুলেশন!' এই ভাবে
কথা বলে তারা ভিসা, টিকেট ও পাসপোর্ট সব
দায়িত্ব নিজেরা নিয়ে শুধু মেডিক্যাল টেস্টের কথা বলে কিছু টাকা দাবি করে ঐ
ব্যাক্তির সর্বস্বান্ত হওয়ার পথ সুগম করে দেয়। বিশেষকরে গ্রামের সরলমনা মানুষগুলো
এই ধোকায় পড়ে থাকে। তারা এটা ভাবে না যে দুনিয়াতে কি চাকুরি প্রত্যাশীদের আকাল যে
এম.ডি নিজে এসে এমপ্লয়ী খুঁজছে? আর বিদেশ
যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট তারা কিভাবে করে দিবে এটাতো নিজের আর পাসপোর্ট ছাড়াই
মেডিক্যাল টেস্ট? আর শহুরে ধোকা খাওয়া লোকেরা এটা চিন্তাই করে না যে এই কোম্পানির
এত টাকার অফার চলছে পত্র-পত্রিকায় এসেছে কিনা? কারণ, মোবাইল কোম্পানিগুলো কোন
অফারই বিজ্ঞাপন ছাড়া ছাড়ে না।
মুশকিলে আসান ফাদ:
'হ্যালো! তোর ঘরে অশান্তি আমি জানি। তোর জামাই
অথবা বৌ তোর কথা শুনে না। তোর শান্তির ঘরে আগুন জ্বলছে...' এই ধরনের মানুষের
স্বাভাবিক জীবনের ঘটনাগুলো বলে কেরামতি জাহের করে এই চক্র। তারপর মান্নত আর এখনই
কিছু টাকা বিকাশ কালকের ফাঁড়া কাটানোর জন্য। খুবই হাস্যকর এই চক্র। কারণ বিয়ের পর
ঘরে ঝগড়া হয় নাই এমন তো কেউই নাই আর ফাঁড়া তথা বিপদ-আপদেই তো মানুষ কিন্তু তারা এই
সাধারণ জিনিসগুলোকেই অধৈর্য মানুষদের সামনে টোপ দেয়। কিন্তু একটু ভাবলেই এদের হাত
থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। কারণ ফাঁড়া আছে কি নাই তাতো আল্লাহই জানে একমাত্র। সে আবার
কোন খোদা। শুধু এই গুলোই নয় বরং ভুয়া ফ্লাক্সিলোড এর ম্যাসেজ দিয়ে পরক্ষনেই ফোন
দিয়ে তা ফেরত চাওয়া তাও আবার কখনো বিকাশের মাধ্যমে আর বিকাশ
একাউন্ট খোলার ফি ইত্যাদি নানা পন্থায় তারা মানুষদের প্রতারিত করছে।
গত বছর নভেম্বরে এমনি একটা ঘটনা ঘটার পর সংশ্লিষ্ট কোম্পানি গ্রামীণফোন লটারি চক্রের সব সিম বাতিল করার আশ্বাস দেয়। এমনিভাবে বাংলালিংক ও এয়ারটেলও এই ব্যপারে পদক্ষেপ নেয়ার আশ্বাস দেয়। তবে এই কুচক্রী মহল চাকুরির আবেদনের সংবাদ বা অন্যান্য তথ্য কোথায় পায় তা অনুসন্ধানে জানা যায় যে মোবাইল অপারেটরগুলো তাদের কল সেন্টারে খণ্ডকালিন যে নিয়োগ দেয় তাদেরই কেউ কেউ এই তথ্যগুলোর অপব্যবহার করে থাকে। তাই বাংলালিংকের কর্পোরেট এন্ড রেগুলেটরি এফেয়ারসের প্রধান জাকিউল ইসলাম লটারি বা কোন সন্দেহ জনক বিষয়ে অফার পেলে ১২১ নাম্বারে জানানোর পরামর্শ দেন। তাছাড়া বিদেশ থেকে অথবা দেশ হতে নির্দিষ্ট নাম্বারে ডায়ালের মাধ্যমে মোবাইলের ব্যলেন্স ও তথ্য হাতিয়ে তথা 'সিম ক্লোনিং' চক্র কাজ করে যাচ্ছে। তবে সিম ক্লোনিং ছাড়াও সফটওয়্যারের মাধ্যমেও তথ্য হাতিয়ে নেয়া সম্ভব বলে মনে করেন ঢাকা গোয়েন্দা বিভাগের উপকমিশনার সানোয়ার হোসেন । কিন্তু কথা হল এই ধরনের কাজ আজ নতুন নয় সংশ্লিষ্ট সকল কোম্পানি আর বিটিসিএল ও এই বিষয়ে জ্ঞাত থাকা সত্বেও এদের চক্রান্ত চলছে। কাদের হাত রয়েছে এই চক্রে আর কারাইবা এই ধরনের কাজ করার সাহস যোগান দিচ্ছে তা যত দ্রুত বের হবে ততই মঙ্গল। আর লাখ লাখ টাকার বিজ্ঞাপনের খরচ থেকে কিছু যদি সমাজকে সচেতন করার জন্য মিডিয়া ইত্যাদিতে ব্যায় হয় তাহলে খুব বেশী ক্ষতি হয়তো হবে না কোম্পানিগুলোর তবে বেশ উপকার হবে এই সরলমনা মানুষগুলোর। তারা বেঁচে যাবে এই দুষ্ট চক্রের হাত থেকে।